ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ত্রয়ী কথন 

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ২১:১৯, ২০ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২১:২০, ২০ জুলাই ২০২০

তোমরা কি জমজ? না আমরা ত্রিমজ। মানে? আমরা তিন বোন। কেউ জিজ্ঞেস করলে এটা ছিল বড় মেয়ের উত্তর। ছোট বেলায় দেখতে একই রকম ছিলো আমার তিন মেয়ে। বড় এশা, আমার মাত্রিত্ত্ব, মেঝো আমার ঢংগী দিশা ও ছোট আহলাদী তিশা। আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা। আমার সবকিছুই ওরা তিনটি বোন। সবাই এখন লেখাপড়ায় একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু এই স্তরে আসাটা অনেক কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে সফল হয়েছে। একজন চাকুরিজীবী মা হিসেবে তিনটি বাচ্চা মানুষ করতে কী কষ্ট হয়েছে সেটা কেবল আমার মতো আরেকজন কর্মজীবী মা ই জানেন। তবুও একান্নবর্তী পরিবারে থাকার জন্য আমি ওদেরকে ছোটবেলায় ভালো কিছু শিক্ষা দিতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ! সে যাই হোক গৌরচন্দ্রিকা অনেক দিয়ে ফেললাম এবার আসল কাহিনীতে আসি।


বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট্ট 
এশা, দিশা ও তিশা

সময়টা ছিল জুন মাস ২০০১ বড় মেয়ে সাড়ে চার বছর। বাসায় ওদের ন্যানি, ভাগ্নে, ভাগ্নী ননাসের জামাই এর কাছে ওদেরকে রেখে আমরা কাজে যাই। জুন মাসে কাজের খুব চাপ। বেলা ৩.৩০ এ ভাগ্নের ফোন, মামী জলদি আসেন এশা নুপুর গিলে ফেলছে। আমি হতভম্ব! নিজের অপারেশন এর ক্ষত এখনো অক্ষত সাথে কাজের চাপ এর উপর আবারও এটা কী শুনলাম? (কিছুদিন আগে আমার একটা ছোট সার্জারি হয়েছিল) কিছু চিন্তা করার আগেই চেয়ারে ঢলে পড়লাম। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম বাসার নীচ তলায়। বুঝতে পারলাম আমার ম্যানেজার স্যার আমাকে অফিসের গাড়ি, সাথে দুজন সহকর্মী দিয়ে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কোন রকমে সবাই আমাকে ধরে নিয়ে দোতলায় বাড়িওয়ালা খালুর বাসায় (উনি ডাক্তার) বসালো। আমি কান্না করছি আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। 

আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন আমার সাধ্য কী তা ধরে রাখার? ছোট মেয়ে দিশাকে (তিশা তখনও জন্মায়নি) ভাগ্নী আমার কোলে দিলো। ও কে জড়িয়ে ধরে আমি চোখ বন্ধ করে কেঁদেই চলেছি হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম। একজোড়া কচি নরম হাতের স্পর্শ আমার দুই গালের অশ্রু মুছে দিয়ে বলছে মা তুমি কান্না করছো কেন আমি তো ভালো আছি। এই যে দেখো গলায় কোনো ব্যথা নাই। শুধু একটা নুপুর থাকলো! চোখ মেলে মেয়ের মুখ দেখে আল্লাহর কাছে শোকরানা নামাজ পড়ে আবার ওকে নিয়ে বসে আছি ডাক্তার এর কাছে যাব বলে। মেয়ে উপরে গিয়ে জামা বদলে ভালো জামা পরে আসলো। কর্তা আসার পরই আমরা খালুকেসহ বারডেম হাসপাতাল এ ইমারজেন্সীতে গেলাম। সে সময় এই হাসপাতালের খুব সুনাম ছিল। 


এশা, দিশা, তিশা ও তাদের বাবার সঙ্গে লেখক

চোখ ছানা বড়া করে কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইমার্জেন্সি ডাক্তার বললেন, এন্ডোস্কোপী করে নুপুর বের করতে হবে কারণ নুপুরটা বেশ বড় আর হুকটা মোটা। ভয় পেয়ে আমার অপারেশন যিনি করেছিলেন সেই সার্জন ভাইয়াকে (আমার কলিগ বান্ধবীর ভাই পিজির সার্জন) ফোন দিয়ে সব জানাতেই বললেন দুটি সাগর কলা খেতে দিতে আর উনার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। 

গাড়ি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থামতেই দেখি অনেক লোকের ভিড়। কারণ জানতে চাইলে বললো একটা সাড়ে চার বছরের বাচ্চা নুপুর গিলে ফেলছে তাই ওকে দেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। ওটি এক্সরে রুমে কোনো রোগী নেই ওর জন্য খালি রাখা হয়েছে। ভাইয়া নিজেই এক্সরে করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘যে ভয়টা করেছিলাম সেটা কেটে গেছে রে। তুই এখন বাসায় গিয়ে ওকে বার্গার কলা, দুধ আর পানি খাওয়া বেশি করে। ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা কর তারপর যদি অপারেশন লাগে আমি করে নুপুর বের করে দিবো’।


শিশুকালে এশা, দিশা ও তিশা

বাসায় এসে মেয়ে তো খুব খুশি। গোলপিয়া বার্গার আর সাগর কলা দুধ সব মজা করে খাচ্ছে আর কেউ ফোনে জানতে চাইলে তাকে নুপুর গেলার কাহিনী বলছে। এভাবে ‘নানু আমি তো মহব্বতেন দেখছিলাম (ভিসিআরে) প্যায়রো মে বন্ধন হ্যায় নাচ হচ্ছিল যখন তখন নিজের নুপুর খুলে হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে গলায় ঢুকে যায়। আর দাদাকে (ওর ফুপাতো ভাই) বলি দাদা আমি নুপুর গিলে ফেলছি। দাদা বল্লো পানি খা তারপর পানি খাই আর নুপুর পেটের ভিতরে চলে গেল বুঝতেই পারিনি। আমি তো ভালো আছি তবুও মা কান্না করে’। হায়রে মা এর মন ওইটুকু বাচ্চা কী বুঝবে আমার কাছে ও কী?

সারারাত দুচোখ বন্ধ করি নাই। জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহকে ডাকছি। মেয়েকে নিজের বিছানায় রাখিনি পাছে কোনো দুঃখের কারণ আমি নিজেই হই? ও ওর ফুপাতো বোন আর আমার ননদের সাথে ঘুমালো। 


এখনকার এশা, দিশা ও তিশা

সকালেও মেয়ে কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপহীন। ঘুরে ফিরে খাচ্ছে আর সবাই (বিল্ডিংয়ের মানুষ আর বাসার সহকর্মীদের) কে বর্ণনা দিচ্ছে গতকালের ঘটনা। আর আমরা সবাই অপেক্ষা করছি কখন নুপুর বিবির দর্শন পাব। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো আমার বেলা ১১.৩৮ এ নুপুর বেগমের রাজকীয় অভ্যর্থনা করলেন আমার ননদ ভাগ্নী আর ন্যানি। উনি দেখা দিলেন মেয়ের নীল পটিতে। আমি তো জায়নামাজেই বসে আছি। আল্লাহকে ডাকছি এবার নফল নামাজ পড়ে আবারও শোকরানা আদায় করলাম আল্লাহর দরবারে।

এখনো দেশে বিদেশে পুরনো কলিগের সাথে দেখা হলে সবাই এশার কথা জিজ্ঞেস করে, আপা নুপুর খাওয়া এশা কতো বড় হয়েছে? আমি উত্তর দেই যে, ও এখন অনেক বড় হয়েছে। আমি বিদেশে গেলে খুব কড়াভাবে সুন্দর করে সংসার সামলায়। বড় হয়েছে আমার মায়েরা। আমার প্রিয় বান্ধবী হয়েছে এশা দিশা ও তিশা। 

শিক্ষাঃ জীবনে কখনো বাচ্চাদের কোন রকম গয়না পরাতে নেই যতদিন না ওরা নিজ থেকে নিজের খেয়াল করতে পারে।

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এমবি// 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি